মোট জাতীয় উৎপাদন (Gross National Product )
একটি দেশের অর্থনীতি ও অর্থনীতির অবস্থা জানার জন্য সে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন সম্বন্ধে জানা দরকার।
অর্থনৈতিক নির্দেশকসমূহ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃতি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বা ভূমির ওপর সে দেশের মোট শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করে যে পরিমাণ বস্তুগত ও অবস্তুগত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার আর্থিক মূল্যকে ঐ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) বলে। সেবা বলতে কোনো অবস্তুগত দ্রব্যকে বুঝায় যার উপযোগ এবং বিনিময় মূল্য আছে। শিক্ষকের পাঠদান, চিকিৎসকের চিকিৎসা প্রদান, ব্যাংকারের অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা পান ইত্যাদি সেবা হিসেবে বিবেচিত।
মোট জাতীয় উৎপাদন পরিমাপ
মোট জাতীয় উৎপাদনকে তিনটি দিক থেকে বিবেচনা করে পরিমাপ করা যায়-
১. উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা
যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে জনগণের প্রয়োজনের ভিত্তিতে নানাবিধ দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত দ্রব্যের বিভিন্নতার কারণে সবগুলো একত্রে যোগ করে এগুলোর মোট পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না। তাই মোট জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণ নির্ণয় করতে হলে প্রতিটি দ্রব্য ও সেবার মোট উৎপাদনের পরিমাণকে তার বাজার নাম দিয়ে গুণ করতে হয়। এভাবে প্রাপ্ত প্রতিটি দ্রব্য ও সেবার আর্থিক মূল্যের সমষ্টিকে মোট জাতীয় উৎপাদন বলে। এ পদ্ধতিতে মোট জাতীয় উৎপাদন নির্ণয় করতে হলে শুধুমাত্র চূড়ান্ত দ্রব্যই গণনা করতে হবে। অনেক দ্রব্যই চূড়ান্ত পর্যায়ে বাজারে আসার আগে প্রাথমিক দ্রব্য ও মাধ্যমিক দ্রব্য হিসেবে একাধিকবার ক্রয়-বিক্রয় হয়। এই ক্রয়-বিক্রয় হয় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। দ্রব্যটি উৎপাদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভোগকারী এটি ক্রয় ও ভোগ করে। ভোগকারীর রুয়ের পর দ্রব্যটি আর ক্রয়-বিক্রয় হয় না। মোট জাতীয় উৎপাদন নির্ণয়ের জন্য প্রত্যেক ধাপেই দ্রব্যটির হিসাব করা হলে জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণ সঠিক হবে না। তাই মোট জাতীয় উৎপাদন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে শুধু চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যটিই হিসাব করতে হবে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড় এবং কাপড় থেকে শার্ট উৎপাদন করা হলো। এখানে তুলা হচ্ছে প্রাথমিক দ্রব্য, সুতা ও কাপড় মাধ্যমিক দ্রব্য এবং শার্ট চূড়ান্ত দ্রব্য। তুলা, সুতা, কাপড় এবং শার্ট—এই চারটি পর্যায়েই দ্রব্যটির দাম হিসাব করা হলে তা হবে একটি ভুল হিসাব। কারণ শার্টের দামের মধ্যেই তুলা, সুতা ও কাপড়ের দাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই উৎপাদন পদ্ধতিতে মোট জাতীয় উৎপাদন গণনা বা পরিমাপ করতে হলে শুধুমাত্র চূড়ান্ত পণ্য যা সরাসরি ভোগ করা হয়, তাই হিসাব করা হয়।
২. উৎপাদনের উপকরণের অর্জিত আয়
এ পদ্ধতিতে মোট জাতীয় উৎপাদন পরিমাপ করতে হলে উৎপাদনের উপাদানসমূহের মোট আয়ের সমষ্টি নির্ণয় করতে হয়। ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন-উৎপাদনের এ চারটি উপাদানের আয় যথাক্রমে খাজনা, মজুরি, সুদ ও মুনাফা। এক বছরে কোনো দেশের জাতীয় আয় হলো ঐ বছরে উৎপাদনের উপাদানসমূহের অর্জিত মোট খাজনা, মজুরি বা বেতন, সুদ ও মুনাফার সমষ্টি।
৩. সমাজের মোট ব্যয়
সমাজের মোট ব্যয়ের ভিত্তিতেও মোট জাতীয় উৎপাদন নির্ণয় করা যায়। এই পদ্ধতি অনুসারে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে দেশের সমস্ত ধরনের ব্যয় যোগ করলে মোট জাতীয় উৎপাদনের আর্থিক মূল্য পাওয়া যায়। কোনো দেশের মোট আয়দু'ভাবে ব্যয়িত হয়- (i) ভোগ্যদ্রব্য ও সেবা কেনার জন্য এবং (ii) বিনিয়োগ করার জন্য। ব্যয়কারীদের প্রধানত তিন শ্রেণিতে বিন্যাস করা যায়: সরকার, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণ। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বেসরকারি ভোগ-ব্যয় ও বিনিয়োগ-ব্যয়ের সমষ্টি ঐ সময়ে ঐ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন। মোট জাতীয় উৎপাদনকে অনেক সময় মোট জাতীয় আয় বলা হয়। যে কোনো সরল অর্থনীতিতে মোট জাতীয় উৎপাদন (Gross National Product : GNP) ও মোট জাতীয় আয় (Gross Nationat Income: GNI) একই হতে পারে। আমরা জানি। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশে উৎপাদিত মোট দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার আর্থিক মূল্যের সমষ্টিকে মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) বলে। কিন্তু এর সঙ্গে সমাজের মোট আয় বা মোট ব্যয়ের সমতা নাও হতে পারে। কারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য ব্যবহৃত মূলধন সামগ্রী, যেমন- কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য মোট জাতীয় উৎপাদনের আর্থিক মূল্য থেকে কিছু অংশ পৃথক করে রাখা হয়। উৎপাদনের উপাদানসমূহের আয়ের মধ্যে এই অংশটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। তাই মোট জাতীয় উৎপাদনের (GNP) আর্থিক মূল্য এবং উৎপাদনের উপাদানসমূহের আয় (খাজনা, মজুরি, সুদ ও মুনাফা) বা জাতীয় আয় এক নয়। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য অনেক সময়ই মোট জাতীয় উৎপাদন ও মোট জাতীয় আয়কে সমার্থকভাবে ব্যবহার করা হয়।
মোট দেশজ উৎপাদন (Gross Domestic Product) মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভিতরে বসবাসকারী সকল জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। এতে উক্ত সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সকল নাগরিক ও বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও কর্মরত দেশের নাগরিক বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না।
যদি x দ্বারা আমরা বিদেশে অবস্থানরত দেশি জনগণের আয় বুঝাই এবং M দ্বারা দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের আয় বুঝাই তাহলে মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) + (X-M)। মোট দেশজ উৎপাদন বুঝতে হলে মোট জাতীয় উৎপাদন বা GNP এর ধারণাটিও মনে রাখতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের জনগণ মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করে তার অর্থমূল্যকে মোট জাতীয় উৎপাদন বলে। জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ও কর্মরত বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থার উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে বিদেশে বসবাসকারী ও কর্মরত দেশি নাগরিক, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে।
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) শুধু দেশের নাগরিকদের উৎপাদন হিসেবে গণনা করে। এ নাগরিকেরা দেশে অথবা বিদেশে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, এক্ষেত্রে নাগরিকই গুরুত্বপূর্ণ। মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) বলতে শুধু দেশের সীমানার ভিতরের মোট উৎপাদনকে বুঝায়। এটা দেশের নাগরিক বা বিদেশি ব্যক্তি যাদের দ্বারাই উৎপাদিত হোক না কেন, এক্ষেত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমানার বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) এর চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে, আবার সমানও হতে পারে।
মাথাপিছু আয় (per Capita Income) : মাথাপিছু আয় হলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের নাগরিকদের গড় আয়। মাথাপিছু আয় দুইটি পৃথক মান দ্বারা নির্ধারিত হয় : (১) মোট জাতীয় আয় এবং (২) মোট জনসংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের মোট জাতীয় আয়কে (GNI) সে দেশের মোট জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে মাথাপিছু জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। মাথাপিছু আয়কে নিম্নলিখিতভাবে প্রকাশ করা যায় :
মাথাপিছু আয় = মোট জাতীয় আয় /মোট জনসংখ্যা
সংকেতের সাহায্যে মাথাপিছু আয় প্রকাশ করলে আমরা পাই :
যেখানে
Y = মোট জাতীয় আয়
P = মোট জনসংখ্যা
ধর, ২০১১ সালের মধ্য সময়ে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি এবং ঐ সময়ে মোট জাতীয় আয় ৭০০০ কোটি মার্কিন
ডলার।
সুতরাং ঐ সময়ে মাথাপিছু আয় =
৭০০০ কোটি মার্কিন ডলার/ ১৪ কোটি
= ৫০০ মার্কিন ডলার
মাথাপিছু আয় ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে। উচ্চ মাথাপিছু আয় উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করে। তবে জীবনমান নির্ধারণের জন্য উচ্চ মাথাপিছু আয়ের সাথে দ্রব্যমূল্যের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি কোনো বছরে কোনো দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়, আবার একই সাথে প্রব্যের মূল্যস্তরও দ্বিগুণ হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে জীবনযাত্রার মান একই থাকবে। কারণ ঐ দ্বিগুণ আয় দিয়ে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে একই পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা ক্রয় করতে পারবে। অর্থাৎ তার আর্থিক আয় দ্বিগুণ হলেও তার প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায়নি। কারণ, আর্থিক আয় ও দ্রব্যমূল্য একই হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মূল্যস্তর অপরিবর্তিত থেকে মাথাপিছু আয় বাড়লে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং মাথাপিছু আয় কমলে জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে।
আবার, জাতীয় আয়ের বণ্টন যদি সুষম না হয় তাহলে মাথাপিছু আয় বাড়লেও অধিকাংশ জনগণের জীবনমান নিচুই থাকে। কারণ, মাথাপিছু আয় একটি গড় মান। জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি অথচ বৃহদাংশের আয় অনেক কম হলেও উভয় অংশের মাথাপিছু আয়ের গড় মান এমন হতে পারে যাতে মনে হয় যে, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। কিন্তু মোট জাতীয় আয়ের এ রকম অসম বণ্টন হলে বেশিরভাগ মানুষের মাথাপিছু আয় মাথাপিছু জাতীয় আয়ের চেয়ে কম হবে। ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রাও উন্নত হবে না। তবে যে দেশে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন আছে, সেসব দেশে মাথাপিছু আয় বাড়লে এবং মূল্যস্তর অপরিবর্তিত থাকলে বা আয় বৃদ্ধির চেয়ে কম হারে বৃদ্ধি পেলে জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পাবে।
২০১৮-২০১৯ চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১,৬০,০৬০ টাকা এবং মার্কিন ডলার হিসেবে ১,৯০৯ ডলার। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, অর্থ মন্ত্রণালয়, ২০১৯ অনুযায়ী)জাতীয় অর্থনীতির খাতসমূহ ও মোট দেশজ উৎপাদনে এগুলোর অবদান অর্থনীতির খাত বলতে বোঝায় অর্থনীতির বিভিন্ন অংশ, বিভাগ বা শাখা। বিশ্বের যে কোনো অর্থনীতিকে প্রধান তিনটি খাতে ভাগ করা হয় : কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। ভূমি ও ভূমি থেকে উৎপন্ন সবকিছু শস্য ও ফলমূল, শাকসবজি, বনজ সম্পদ, পশু ও মৎস্যসম্পদ প্রভৃতি কৃষি খাতের অন্তর্গত। বৃহদায়তনও ক্ষুদ্রায়তন শিল্প, সব ধরনের নির্মাণ, খনিজ দ্রব্যাদি সংক্রান্ত সকল কাজ শিল্প খাতের অন্তর্গত। অবশিষ্ট সকল ক্ষেত্র, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, ব্যাংক, বিমা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ডাক, তার, যোগাযোগ ও পরিবহন- এসব কিছুই সেবা খাতের আওতাধীন। তবে বিভিন্ন দেশে বাজেট বরাদ্দ এবং কাজ করার সুবিধার জন্য এ তিনটি প্রধান খাতের প্রত্যেকটিকে আবার কিছু সংখ্যক উপখাতে ভাগ করা হয়। যে কোনো দেশের অর্থনীতিকে বেশকিছু খাতে ভাগ করা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোট ১৫টি প্রধান খাতে ভাগ করা হয়। এই ১৫টি খাত হচ্ছে: (১) কৃষি ও বনজ (২) মৎস্য (৩) খনিজ ও খনন (৪) শিল্প, (৫) বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সম্পন্ন (৬) নির্মাণ (৭) পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য (৮) হোটেল ও রেস্তোরাঁ (১) পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ (১০) আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা (১১) রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসা ( ১২) লোকপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা (১৩) শিক্ষা (১৪) স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা ও (১৫) কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা। তবে এ ১৫টি খাতকে ৩টি বৃহত্তর খাতে সমন্বিত করা যায়, যেমন- - কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত।
কৃষি খাত : কৃষি খাতে রয়েছে কৃষি ও বনজ। বৃহত্তর অর্থে মৎস্য সম্পদও কৃষি খাতের অন্তর্গত।
শিল্প ও বাণিজ্য খাত শিল্প খাতের মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প। তবে বৃহত্তর অর্থে খনিজ ও খনন, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সম্পদ এবং নির্মাণ- এই খাতগুলোকেও শিল্প খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য এবং রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসায়-এ খাতের আওতায় পড়ে।
সেবা খাত : হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ, আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা (ব্যাংক ও বিমা) ইত্যাদি সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত। লোক প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা: শিক্ষা স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা এগুলো এ খাতের আওতাভুক্ত।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনে খাতওয়ারি অংশ বা অবদান হিসেবে উক্ত ৩টি সমন্বিত খাতের মধ্যে সবচেয়ে উপরে রয়েছে শিল্প ও বাণিজ্য। এখাতের অবদান ২১.৭৪। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য খাত। মোট দেশজ উৎপাদনে এর অংশ ১৪.০১%। তৃতীয় স্থানে রয়েছে সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাত। মোট দেশজ উৎপাদনে এর অবদান ১১.২৬%।মোট দেশজ উৎপাদনে অর্থনীতির ১৫টি বিভিন্ন খাতের অংশ বা অবদান সারণি-১ এ উপস্থাপন করা হলো।
কয়েকটি দেশের জিএনপি, জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের তুলনা
আমরা জানি, যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক সে দেশের জনগণের মাথাপিছু আয়। তবে একটি দেশ উন্নত, অনুন্নত নাকি উন্নয়নশীল, তা নির্ধারণের জন্য মাথাপিছু জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, অর্থনীতির প্রকৃতি অর্থাৎ অর্থনীতি কৃষি প্রধান না কি এর শিল্পায়ন ঘটেছে, সাক্ষরতার হার, জনগণের কাছে স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা, অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ঊর্ধ্বমুখী উন্নয়ন ঘটেছে কিনা অর্থাৎ পরিবহন, যোগাযোগ সুবিধা এবং মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের হার ঊর্ধ্বমুখী কিনা এসবও বিবেচ্য বিষয়।
তবে বিশ্বব্যাংক মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে পৃথিবীর দেশগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছে। এগুলো হলো: উচ্চ আয়ের হয়েছে : উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ (Upper Middle Income Countries) এবং নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ (Lower Middle Income Countries)। নিচে আয়ভিত্তিক শ্রেণিগুলো দেখানো হলো :
উপরের সারণি ২ লক্ষ কর। সারণিটিতে ২০২০ সালে জনসংখ্যা ও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বেশকিছু দেশকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখানো হয়েছে। এগুলো হলো উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশ। মধ্য আয়ের দেশকে আবার উচ্চ মধ্য আয় ও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ভাগ করে দেখানো হয়েছে। এ তথ্য বিশ্বব্যাংক তার ২০২০ এর রিপোর্টে দেখিয়েছে।
উচ্চ আয়ের দেশসমূহ উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃত। উন্নয়ন প্রক্রিয়া শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছানোর ফলেই এসব দেশ এই উন্নত অবস্থা অর্জন করেছে। এসব দেশের মাথাপিছু আয় এমন যে জনগণের সকল মৌলিক চাহিদা পূরণের পরও প্রচুর অর্থ
উদ্বৃত্ত থাকে—যা সঞ্চয় ও মূলধন গঠনে ব্যয় হয়। এসব দেশ উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে অধিকতর উন্নয়ন কার্যক্রম চালায় এবং উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে সহায়তা করে। উপরের সারণি-২ তে লেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এবং এশীয় দেশসমূহের মধ্যে জাপান ও সিংগাপুর উচ্চ আয়ের দেশ' শ্রেণিভুক্ত। ২০১৮ সালে এসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৩৮৪২৮ ডলার থেকে ৭৫৫০৪ ডলারের মধ্যে।
মধ্য আয়ের দেশসমূহ সাধারণত উন্নয়নশীল দেশ। তবে মধ্য আয়ের এসব দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো সামাজিক অবকাঠামোর দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী উন্নয়ন ঘটছে। তবে উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে পৌঁছাতে এসব দেশকে এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। উপরের সারণিতে অন্তর্ভুক্ত উচ্চ মধ্য আয়ের দেশগুলোর জনগণের মাথাপিছু আয় ৫৪১৫ ডলার থেকে ১০৫৪১ ডলার পর্যন্ত। এদেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন,ইরান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকা। মধ্য আয়ের দেশ' শ্রেণির নিচের ধাপে দেশ' হিসেবে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশর, নাইজেরিয়া, কম্বোডিয়া ও কেনিয়া - এ সাতটি এশীয় ও আফ্রিকান দেশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ১৩৮৪ ডলার থেকে ২৪১৩ ডলার পর্যন্ত। মাথাপিছু জাতীয় আয়ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের সবচেয়ে নিচে রয়েছে 'নিম্ন আয়ের দেশ'। এ দেশগুলোকে কোনো কোনো সময় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও মূলত এগুলো অনুন্নত দেশ। তবে এসব দেশের অধিকাংশে উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে বেশ কিছুকাল থেকেই। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশগুলো কিছুটা উন্নয়নও অর্জন করেছে। সেজন্য অনেক ক্ষেত্রেই এদেশগুলোকে অনুন্নত না বলে স্বল্পোন্নত দেশ বলা হয়। সারণিতে এই শ্রেণিতে এশীয় দেশের মধ্যে নেপাল এবং আফ্রিকান দেশের মধ্যে উগান্ডাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। সারণিতে অন্তর্ভুক্ত 'নিম্ন আয়ের দেশ' সমূহের মাথাপিছু আয় ৬০০ ডলার থেকে ৮০০ ডলারের মধ্যে। উল্লেখ্য যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রিপোর্ট- ২০১৮ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮ অনুসারে ২০১৬-২০১৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১৬১০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে ২০৬৪ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
কোনো দেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য প্রধানত সে দেশের অর্থনীতির প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতির প্রকৃতি আবার দেশের ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, জনগণের শিক্ষা ও দক্ষতার স্তর এবং তাদের উদ্যম ও উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা-এ সবকিছুর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতি অতি প্রাচীনকাল থেকেই একটি কৃষিপ্ৰধান বা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। এ পাঠে আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে জানব ।
১. কৃষিপ্রধান অর্থনীতি : অতি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান অর্থনীতি
হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্য খাতসহ কৃষিখাতের অবদান প্রায় ১৪.৭৩ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তির মোট ৪০.৬০ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত। দেশের রপ্তানি আয়েও কৃষি খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। খাদ্যশস্য কৃষি খাতের অন্যতম প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ক্রমবর্ধমান এবং জনসংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। এতদ সত্ত্বেও দেশটি ক্রমশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। এছাড়া আমাদের শিল্প খাতের অনেক কাঁচামালের যোগান দেয় আমাদের কৃষি খাত, যেমন- পাট শিল্প, চা, চামড়া শিল্প ইত্যাদি। এসব কারণেই কৃষি খাত এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত।
নিচের সারণি-৩ এ বাংলাদেশে ১৯৯০-১৯৯১ থেকে ২০১৬-২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দেখানো হলো। লক্ষণীয় যে, এই উৎপাদন ক্রমবর্ধমান।
২. কৃষি খাতের প্রকৃতি : কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিস্বরূপ। তবে এখন এত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কৃষি উৎপাদন প্রণালি এখনও সম্পূর্ণ আধুনিক হয়ে ওঠেনি। চাষাবাদের আওতাধীন জমির বৃহদাংশে এখনও পর্যন্ত সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদ চলছে। এর ফলে কৃষিজমির উৎপাদনশীলতাও কম।এছাড়া এদেশের কৃষি প্রকৃতিনির্ভর। বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণ কৃষি উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হলে বা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে উৎপাদন বিপুল পরিমাণে কমে যায়। কৃষিখাতের আরেকটি বড় ত্রুটি হলো কৃষক বা কৃষি মজুরদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া সবক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায় না। এছাড়া পরিবহন সুবিধার অপ্রতুলতা ও বাজার ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে প্রকৃত উৎপাদকেরা অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না। এ বিষয়টি দেশের সমগ্র কৃষি ক্ষেত্রে একটি বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৩. শিল্প খাতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ও অবদান : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের গুরুত্ব ও অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে স্থির মূল্যে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ১৭.৩১ শতাংশ। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ৩৩.৬৬% এর বেশি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বৃহৎ শিল্প, খনিজ ও খনন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ এবং নির্মাণ-এ খাতগুলোর সমন্বয়ে শিল্প খাত গড়ে উঠেছে।
৪. শিল্প খাতের প্রকৃতি : মোট দেশজ উৎপাদনে শিল্প খাতের অবদান ক্রমবর্ধমান হলেও আমাদের শিল্প খাতে মৌলিক ও ভারী শিল্পের (Basic and Heavy Industries) অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সার কারখানা, চিনি ও খাদ্যশিল্প কর শিল্প, পাটশিল্প, চামড়া শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প প্রভৃতি দেশের প্রধান প্রধান শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু অর্থনীতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে দ্রুত শিল্পায়ন প্রয়োজন। এজন্য ভারী বা মৌলিক শিল্প, যেমন-গৌহ ও ইস্পাত শিল্প, অবকাঠামোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানি শিল্প ইত্যাদি অত্যাবশ্যক। দেশে ভারী যানবাহন সংযোজন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও জলযান নির্মাণ ও মেরামত প্রভৃতি শিল্প রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এগুলোও অপ্রতুল।
৫. জনসংখ্যাধিক্য ও শিক্ষার নিম্নহার : বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এর জনসংখ্যাধিক্য। এদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪,৯৭,৭২,৩৬৪ জন । জনবসতির ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন (আদমশুমারি ২০১১)। কিন্তু ২০১৮ সালের বি বি এস অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১২৫২ জন বাস করেন। বাংলাদেশ জনসংখ্যাধিক্যের দেশ হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমহ্রাসমান। আদমশুমারি রিপোর্ট ১৯৯১ ও ২০০১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২.১৭% ও ১.৪৮%। এ হার ক্রমশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩৭%-এ (আদমশুমারি রিপোর্ট, ২০১১)।
তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উভয়ই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। UNFP ও WORLD POPULATION REVIEW 2019 অনুসারে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া এসব দেশে ২০১৯ সালে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে যথাক্রমে ৪১২, ২২৮, ৩১৯, ৮০ ও ৯৭ জন। আর এ দেশগুলোতে ২০১০-২০১১ সময়কালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ছিল যথাক্রমে ১.২%, ২%, 0.8%, 0.5% 3.6% 1জনসংখ্যাকে দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখন পর্যন্ত একটি সমস্যা। এর কারণ বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৮। অর্থাৎ ২৭.২ শতাংশ জনগণ নিরক্ষর (UNDP, Human Development Report-2018) নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, এদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে উদ্যোগী করে তোলা, মূলধনের জোগান দেওয়া, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় চাপ সৃষ্টি করছে।
৬. ব্যাপক বেকারত্ব = জনসংখ্যাধিক্য এবং দ্রুত শিল্পায়নের অভাব দেশে বেকারত্বের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার। দেশে মজুরির হার কম বলে দিনমজুরদের অধিকাংশকে অর্ধ বেকার হিসেবে গণ্য করা যায়।
৭. স্বপ্ন মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার নিম্নমান মজুরির নিম্নহার, ব্যাপক বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্বের ফলে জনগণের গড় আয় অর্থাৎ মাথাপিছু আয় কম। বাংলাদেশে ২০১৮-২০১৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৯০৯ মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০২০ সালে মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার। এই আয় প্রতিবেশি শ্রীলংকা ও ভারতের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে কম। এ দুটো দেশের মাথাপিছু আয় যথাক্রমে ৪০৭৩.৭৪ ও ১৯৪২.১০ ডলার (ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০১৮)। নিম্ন মাথাপিছু আয়ের কারণে জীবনযাত্রার মানও নিম্ন। দেশের ২৪.৮ শতাংশ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ জনগণের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৮ )
৮. সঞ্চয়, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগের নিম্নহার মাথাপিছু আয় নিম্ন হওয়ায় জনগণের সঞ্চয়ের হার কম যা জিডিপির ২২.৮৩%। তাই মূলধন বা পুঁজি গঠনের এবং উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগের হারও কম অর্থাৎ জিডিপির ২৭.৪২%। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৮)। আবার বিনিয়োগের নিম্নহারের কারণে নতুন শিল্প স্থাপনের গতি মন্থর। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের হারও কম। বাংলাদেশ এমনই একটি দারিদ্র্যের চক্রের মধ্যে আবদ্ধ। তবে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
৯. অবকাঠামোর দুর্বলতা : অবকাঠামো প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়: সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ইত্যাদি সামাজিক অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা (ডাক ও টেলিযোগাযোগ, ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ইত্যাদি), পরিবহন (স্থল, পানি ও আকাশপথে), আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বিমা প্রভৃতি), শিল্পের জন্য ঋণদানকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ, বাঁধ ও সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদি অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। এই আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তিস্বরূপ। অবকাঠামো উন্নত না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করা যায় না। বাংলাদেশে এই অবকাঠামো অনুন্নত ও অপর্যাপ্ত।
১০. বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা : আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর বাংলাদেশ অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। তবে বিগত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বৈশ্বিক বিভিন্ন পরিবর্তনজনিত কারণে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তি ক্রমশ কমে আসছে।
১১. বৈদেশিক বাণিজ্য : বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রধানত স্বল্পমূল্যের কৃষিজাত পণ্য চা, কাঁচাপাট শিল্প পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার, চামড়া, পাটজাত দ্রব্য, সিরামিক দ্রব্যাদি ইত্যাদি ও শ্রমিক রপ্তানি করে। কিন্তু বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে উচ্চমূল্যের মূলধনসামগ্রী (কলকব্জা, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি); জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম এবং খাদ্য ও বিলাসদ্রব্য (রঙিন টেলিভিশন, গাড়ি, প্রসাধনসামগ্রী ইত্যাদি)। বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরেই রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে।
১২. প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উর্বর কৃষিজমি, নদ-নদী, প্রাকৃতিক জলাশয় এবং ভূগর্ভস্থ খনিজসম্পদ। খনিজ সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, চুনাপাথর, সিলিকা, বাজু, সাদা মাটি, চীনা মাটি, কঠিন শিলা ইত্যাদি।
প্রধানত যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং দক্ষতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে জনগণের বড় একটি অংশ খাদ্যাভাব ও পুষ্টিহীনতার শিকার। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিজ্ঞান শিক্ষা, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার বিস্তার ঘটেনি। এসব কারণে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর অংশকেই মানবসম্পদে রূপান্তর করা এখনও সম্ভব হয়নি। এর ফলে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের সম্পূর্ণ পরিমাণ জানা ও এগুলোর পূর্ণ ব্যবহারও এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
আরও দেখুন...